Type Here to Get Search Results !

ভারতীয় বিভিন্ন মতবাদ - Different Theory of India

ভারতীয় বিভিন্ন মতবাদ - Different Theory of India


ভারতীয় বিভিন্ন মতবাদ

জগতে বিভিন্ন মতবাদ আছে। যুগে যুগে মুনি ঋষিগণের আর্বিভাব হয়। ঋষিগণ সাধনা করে লব্দ জ্ঞান প্রচার করেন। এই প্রচারিত ধর্মগুলোর দুইটি ধারা। একটি হল ঈশ্বরবাদ এবং অপরটি হল নিরিশ্বরবাদ। তা অনাদি অনন্তকাল ধরে চলে আসছে। কখন, কোথায় থেকে শুরু তা বলা কঠিন।

ঈশ্বরের রূপ, প্রকৃতি, নিয়েও একেক মতবাদে একেক রকম বিশ্বাস বিরাজ করে। যারা ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী তারা বলেন, জগতের গাছ-পালা, মাটি, জল, বায়ু, অগ্নি, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, প্রাণী-কুল স্থাবর, জঙ্গম সকল কিছু ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তার ইশারায় সব কিছু পরিচালিত হয়। তিনিই একমাত্র মালিক।


ভারতীয় মহর্ষি গৌতম

ভারতীয় ন্যায় দর্শনের প্রচারক মহর্ষি গৌতম। তাদের মতে ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ। তিনি জগৎ সৃষ্টি করেন, রক্ষা করেন এবং ধ্বংস করেন। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, সমুদ্র, পর্বত প্রভৃতি সৃষ্টি হল তার কার্য। ঈশ্বর শাশ্বত এবং জীবের কর্মফল দাতা। সকল অদৃষ্টের (পাপ-পুণ্যের) অধিষ্ঠাতা। জীবের পাপ-পুণ্যের বিচার করে ফল প্রাপ্তির ব্যবস্থা করেন। ঈশ্বরই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। তাদের মতে দুই প্রকারের আত্মা আছে। জীবাত্মা এবং পরমাত্মা এই পরমাত্মাকে ঈশ্বর বলে দাবি করেন।


যোগ দর্শন

যোগ দর্শনও ঈশ্বরকে স্বীকার করে। মহর্ষি পতঞ্জলি যোগ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। তার মতে অবিদ্যাদি ক্লেশকর্ম, বিপাক, আসব যাকে স্পর্শ করতে পারে না এরূপ পুরুষ বিশেষকে ঈশ্বর বলে। ঈশ্বর সর্বদোষ, সর্বক্রেশ মুক্ত। নিত্য, অনাদি অনন্ত, সর্বজ্ঞ, সর্বদ্রষ্টা, এক এবং অদ্বিতীয়।


বেদন্ত দর্শন

বেদান্ত দর্শনের প্রনেতা মহর্ষি বাদরায়ণ। মহাভারত, পুরাণ এবং ভাগবৎ রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ, বেদব্যাস এবং বাদরায়ণ একই ব্যক্তি বলে অনেকে মনে করেন। তবে এর সম্পর্কে মতবিভেদও আছে। বেদান্ত অর্থ বেদের অন্ত বা শেষ। বেদান্ত বলতে প্রধানতঃ উপনিষদকেই বোঝায়। বেদের তিনটি অংশ। প্রথমে সংহিতা, তারপর ব্রাক্ষণ এবং সর্বশেষ উপনিষদ। বৈদিক চিন্তাধারার সর্বোচ্চ পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে উপনিষদে।


উপনিষদ

ঈশ্বরের স্বরূপ, প্রকৃতি, জগৎ সৃষ্টি, বিলয়, আত্মা সম্পকে উপনিষদের ভাষ্যকারদের মধ্যে কিছুটা মতবিভেদ রয়েছে। কেহ দ্বৈতবাদী কেহ অদ্বৈতবাদী। তন্মধ্যে শঙ্কর এবং রামানুজের মতবাদই সুপ্রসিদ্ধ।


দ্বৈতবাদ

দ্বৈতবাদী বলতে দ্বিতত্ববাদী। তাঁদের মতে জীব ব্রহ্ম দুইটি ভিন্ন তত্ত্ব। উপনিষদের ভাষ্যকার মধ্বাচার্য এই মতবাদের সমর্থক। আবার অদ্বৈতবাদ হল একেশ্বরবাদ। তাদের মতে আত্মাই ব্রহ্ম। জীবাত্মা এবং পরমাত্মা এক অভিন্ন।সর্বং খল্বিদংব্ৰহ্মসমস্তই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই জগতের মূল কারণ। জম্মাদ্যস্য যত:” যার থেকে এই বিশ্বের উৎপত্তি, যাতে স্থিতি এবং লয়, তিনিই ব্রহ্ম বা ঈশ্বর। 


অদ্বৈতবাদ

শঙ্করাচার্য এবং রামানুজ উভয়ে অদ্বৈতবাদের অনুসারী। তবে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ কেবলা দ্বৈতবাদ এবং রামানুজের অদ্বৈতবাদ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ নামে পরিচিত।

রামানুজের মতে ব্রহ্ম অসংখ্য সগুণের আধার। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। উর্ণনাভ যেমন নিজের দেহের অভ্যন্তর থেকে তন্তু নির্গত করে জাল তৈরী করে, ব্ৰহ্মও তেমনি নিজের আভ্যন্তরীণ শক্তির সাহায্যে এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন। ব্রহ্মই সৃষ্টিকর্তা। তবে চিৎ এবং অচিৎব্রহ্মের দুই অবিচ্ছেদ্য অংশ। চিৎ অংশ থেকে জড় জগতের এবং অচিৎ অংশ থেকে জীব জগতের উৎপত্তি।

প্রলয় কালে যখন জগৎ ধ্বংস হয় তখন চিৎ এবং অচিৎ অব্যক্তভাবে কারণ ব্রহ্ম হিসাবে অবস্থান করে। আবার সৃষ্টির পরে যখন ব্রহ্মের চিৎ এবং অচিৎ অংশ যথাক্রমে জীবজগৎ জড়-জগৎরূপে প্রকাশিত হয় তখন ব্রহ্মের এই অবস্থাকে বলা হয় কার্য ব্রহ্ম

রামানুজের মতে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিই জীবের মুক্তির হেতু। ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসর্মপন করাকে বলে আর্ত-প্ৰপত্তি। এর অভাব ঘটলে ঈশ্বরের কৃপা লাভ করা যায় না। ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া মোক্ষলাভ সম্ভব নয়। ভক্ত যখন ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে সমর্পন করেন, নিরন্তর প্রেমময় ঈশ্বরের ধ্যান করেন তখনই ঈশ্বর সাক্ষাৎ ঘটে। ঈশ্বর সাক্ষাৎ হলে তার প্রসাদে ভক্তের মধ্যে পূর্ণ জ্ঞানের উদয় হয়। ফলে চৈতন্য দোষমুক্ত হয়ে ব্রহ্মের তুল্য হয়।

শঙ্করাচার্য ব্রহ্মকে দুইটি দৃষ্টি ভঙ্গিতে প্রত্যক্ষ করেছেন। ব্যবহারিক দৃষ্টিতে জগৎ সত্য। ব্রহ্ম জগতের স্রষ্টা, সংরক্ষক সংহারক। ব্রহ্ম অনন্তশক্তি সম্পন্ন, সর্বজ্ঞ, মায়াশক্তি বিশিষ্ট। এই ব্রহ্ম হলেন সগুন ব্রহ্ম বা ঈশ্বর। এই সগুণ ব্রহ্ম পূজা এবং উপাসনার বস্তু। সগুণ ব্রহ্মের ব্যবহারিক সত্তা আছে, কিন্তু কোন পরমার্থিক সত্তা নেই। পরমার্থিক দৃষ্টিতে ব্রহ্ম নির্গুন, নির্বিশেষ, নিষ্ক্রিয় নিরাকার। ব্রহ্ম অসীম। কারণ ব্রহ্মের বাহিরে কোন কিছুর অবস্থান সম্ভব নয়। ব্ৰহ্ম নির্গুণ। গুণের মাধ্যমে পদার্থ সীমিত হয়। ব্রহ্ম নিষ্ক্রিয়, কারণ ক্রিয়া পরিবর্তন সূচনা করে এবং পরিবর্তন অভাব সূচনা করে। ব্রহ্মে কোন অভাব থাকতে পারে না। পরমার্থিক জ্ঞানে ব্ৰহ্ম স্বজাতীয় বিজাতীয় সকল প্রকার ভেদ রহিত। শঙ্করের মতে সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরোপসনা নির্গুণ ব্রহ্মকে উপলব্দি করার উপায়স্বরূপ।

পরমার্থিক দৃষ্টিতে জীবাত্মা ব্রহ্ম অভিন্ন।জীব ব্রহ্মৈব পরঃ জীবই ব্ৰহ্ম, ব্রহ্মই সব। জীবাত্মাই ব্রহ্ম। জীবাত্মা পরমাত্মা এক।


কনাদ মতবাদ

ঋষি কনাদ হলেন বৈশেষিক দর্শনের প্রবক্তা। তিনিও ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। তার মতে আত্মা দু'প্রকার জীবাত্মা এবং পরমাত্মা। জীবাত্মা অসংখ্য, কিন্তু পরমাত্মা এক। এই পরমাত্মাই হল ঈশ্বর।

কনাদ এর মতে ক্ষিতি, অপ, তেজঃ, বায়ু এর ক্ষুদ্রতম কনা যাকে আর বিভাগ করা যায় না এমন সূক্ষ্মতম কণিকাগুলো হল পরমানু। এই পরমানু গুলোর সাহায্যে জড় জগতের সৃষ্টি এবং লয়। পরমানুর সংযোগে এবং বিয়োগেই বস্তুর উৎপত্তি এবং বিনাশ। পরমানুগুলো আপনা-আপনি সংযুক্ত বা বিযুক্ত হতে পারে না। কোন বুদ্ধিমান কর্তা পরমানুগুলোকে সংযুক্ত এবং বিযুক্ত করেন। এই বুদ্ধিমান কর্তা হলেন ঈশ্বর। ঈশ্বর জগতের নিমিত্ত কারণ এবং পরমানু জগতের উপাদান কারণ। বৈশেষিক দর্শন ঈশ্বর এবং পরমাণু উভয়ের সহ-অবস্থানের কথা স্বীকার করে।


নিরীশ্বরবাদ

এতক্ষণ ঈশ্বর, দ্বৈত, অদ্বৈতবাদ নিয়ে আলোচনা করা হল। এবার নিরিশ্বরবাদ নিয়ে আলোচনা করা যাক। যে মতবাদে ঈশ্বর, ঈশ্বরের নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব, ঈশ্বরের আলোচনাকে মৌলিক আলোচনা বলে স্বীকার করে না তাদের এমন মতবাদকে নিরিশ্বরবাদ বলা হয়। চার্বাক দর্শন, সীমাংসা দর্শন, জৈন দর্শন, বৌদ্ধ দর্শন, এই মতবাদের অনুসারী।


চর্বাক দর্শন

চার্বাক দর্শন অত্যন্ত পুরাতন দর্শন। চার্বাক নামে একজন ঋষিই চার্বাক দর্শনের প্রবর্তক। বেদ, প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্য, রামায়ণ মহাভারত মহাকাব্যে এই মতবাদের উল্লেখ দেখা যায়। চার্বাক দর্শন আত্মসুখবাদের প্রচারক এবং ইন্দ্রিয় সুখই জীবনের একমাত্র কাম্যবস্তু।” “যাবৎ জীব্যে সুখং জীব্যে, ঋণং কত্বা ঘৃতং পিব্যে।যতদিন বাঁচ সুখেই বাঁচ, ঋণ করেও ঘি খাও। খাওয়া দাওয়া অর্থাৎ আহার, পানীয় জাগতিক সুখই চাবাক দর্শনের কাম্যবস্তু।

এখানে অনুমানের উপর নির্ভর করে কোন কিছু গৃহীত হয় না। সবকিছু প্রমান সাপেক্ষে স্বীকার করে নেওয়া হয়। ঈশ্বর, আত্মা, অদৃষ্টশক্তি প্রভৃতিতে বিশ্বাস স্থাপন করা যায় না। কারণ তা অনুমান নির্ভর, প্রমান নির্ভর নয়। প্রত্যক্ষের বিষয়বস্তু নয় বলে ঈশ্বরের কোন অস্তিত্ব নেই। এই জগতের সৃষ্টি কর্তা হিসাবে কোন জগৎ স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুমান করা নিষ্প্রয়োজন। ক্ষিতি, অপ, তেজঃ মরুৎ চারটি জড় উপাদান নিজ নিজ অন্তর্নিহিত স্বভাব ধর্মবশত: ক্রিয়া করে এবং তার ফলে এই জগৎ সব জাগতিক বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে। তাই মতবাদকে স্বভাববাদ নামেও অভিহিত করা হয়

প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, ক্ষিতি, অপ, তেজঃ মরৎ চারটি মহাভূতের সংমিশ্রণে যে দেহ গঠিত হয় তাতে চৈতন্যের আর্বিভাব কিভাবে সম্ভব? উত্তরে চার্বাকরা বলেন যে- পান, সুপারি চুন এদের কোনটির মধ্যেই কোন লাল আভা নেই, তবু এদের একসঙ্গে চর্বণ করলে একটা লাল আভা দেখা দেয়। অনুরূপ ভাবে চারি মহাভুত যদিও চৈতন্য ধর্মবিশিষ্ট নয়, তবু নির্দিষ্ট পরিমাণে এদের সংমিশ্রণে যে জীবদেহ গঠিত হয় তাতে চৈতন্যরূপ গুণের আর্বিভাব ঘটে। চৈতন্য হল উপবস্তু, দেহ ভিন্ন চৈতন্যের কোন স্বতন্ত্র সত্তা নেই। যেহেতু দেহ ভিন্ন চৈতন্যের অস্তিত্ব নেই, সেই হেতু আত্মার অমরতার প্রশ্ন অবান্তর।


মীমাংসা দর্শন

মীমাংসা দর্শন বলে, আত্মা নিত্য বিভূ দ্রব্য। আত্মা দেহ, ইন্দ্রিয় মনের অতিরিক্ত সত্তা। আত্মা অবিনাশী। দেহের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে আত্মার বিনাশ হয় না। দেহের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গেই যদি আত্মার বিনাশ ঘটত তাহলে স্বর্গ প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে বৈদিক যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানের বিষয়টি অর্থহীন হয়ে পড়ে। কর্মফল ভোগের জন্যই আত্মা একটির পর একটি দেহ ধারণ করে। চৈতন্য আত্মার স্বাভাবিক ধর্ম নয়, আগন্তুক ধর্ম। আত্মা স্বরূপত: অচেতন নিষ্ক্রিয়। আত্মা যখন মনের সঙ্গে, মন ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে এবং ইন্দ্রিয় বাহ্য বস্তুর সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়, তখন আত্মার চেতনার আর্বিভাব ঘটে।

মীমাংসকগণ কোন জগকর্তা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাদের মতে কর্ম নিয়মানুযায়ী জগৎ সৃষ্টি এবং জীবের কর্মফল ভোগ। সুতরাং কর্মদাতারূপেও ঈশ্বরকে স্বীকার করার কোন প্রয়োজন নেই।

তাদের মতে এই জগৎ দুঃখপূর্ণ। বিষয়টি জীব যখন উপলব্দি করতে পারে তখন তার জগৎ জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণার সঞ্চার হয়ে মনে বৈরাগ্য দেখা দেয় এবং সকাম কর্ম সম্পাদনের ইচ্ছা সে পরিত্যাগ করে। তারপর আত্মজ্ঞান লাভ করে নিষ্কাম ভাবে কর্ম সম্পাদন করলে সঞ্চিত কর্মফলের বিনাশ ঘটে এবং নতুন কর্মফল ভোগের সম্ভাবনা আর থাকে না। ফলে পুনর্জন্ম বন্ধ হয়ে যায়।


জৈন দর্শন

জৈন দর্শন খুবই প্রাচীন দর্শন এবং প্রাগৈতিহাসিক যুগে জৈন ধর্মের প্রথম আবির্ভাব ঘটে। চব্বিশ জন তীর্থস্কর এই ধর্মের প্রচারক। সর্বশেষ তীর্থস্কর হলেন মহাবীর। তিনি ছিলেন গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক এবং আর্বিভাবকাল খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ট শতকে। জৈনরা নিরীশ্বরবাদী। এই নিরীশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠার পক্ষে জৈনদের যুক্তি হল - কি প্রত্যক্ষ, কি অনুমান, কোনটির সাহায্যেই ঈশ্বরের, অস্তিত্ব প্রমান করা যায় না। যার দেহ আছে তিনিই কার্যের কর্তা হতে পারেন। ঈশ্বর যখন বিদেহী বা নিরবয়ব, তখন তিনি জগতের কর্তা হবেন কি ভাবে? প্রত্যেক কার্যেরই কারণ আছে সত্য, কিন্তু এই পৃথিবী যে কার্য তার প্রমান কোথায়? কার্য কালে সৃষ্টি হয়, কিন্তু আদিহীন অন্তহীন পৃথিবী কোন কালে সৃষ্টি হয়নি। সেই কারণে এই পৃথিবীর কোন কারণ নেই এবং কোন কর্তার কল্পনাও নিষ্প্রয়োজন। নিত্যত্ব, পূর্ণতা, অখন্ডত্ব, সর্বশক্তিমত্তা প্রভৃতি গুণ ঈশ্বরে আরোপ করা হয়। কিন্তু এগুলো ঈশ্বরের গুণ হতে পারে না। জৈনরা বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করেন না, যেহেতু জৈনরা নাসিকবাদী।

তাদের মতে যে দ্রব্যের চেতনা আছে তাহাই জীব। জীব এবং আত্মা অভিন্ন। চৈতন্য আত্মার স্বরূপগত ধর্ম। আত্মাই জ্ঞাতা, কর্তা ভোক্তা। আত্মা নিত্য এবং অপরিনামী। কর্মশক্তির প্রভাবহেতু আত্মা পরপর এক একটি দেহ ধারণ করে এবং যখন যে দেহে থাকে সেই দেহের আকার ধারণ করে।

প্রদীপের আলোক যেমন একটি কক্ষকে আলোকিত করে সেইরূপ আত্মা যে দেহে অবস্থান করে, সেই সমগ্র দেহখানিকে চৈতন্যযুক্ত করে রাখে। শকটের যেমন চালক আছে, তেমনি দেহেরও চালক বা নিয়ন্ত্রক আছে- তা হল আত্মা। ইন্দ্রিয় গুলোকে আত্মাই চালনা করে। কুম্ভকার যেমন ঘটের নির্মাতা, তেমনি এই দেহের নির্মাতা হল আত্মা।

কর্মের জন্যই আত্মার বদ্ধ অবস্থা। পূর্বজন্মের কৃত কর্মের ফলে কামনা, বাসনা, ভোগ, লালসার সৃষ্টি হয় এবং এই কামনা বাসনার জন্য আত্মাকে দেহ ধারণ করতে হয়। কামনা বাসনার মূলে রয়েছে অজ্ঞানতা বা মিথ্যা জ্ঞান। সম্যক জ্ঞানের সাহায্যে এই অজ্ঞানতা দূর করা যেতে পারে সিদ্ধপুরুষ তীর্থঙ্করদের উপদেশাবলী মনযোগ সহকারে পাঠ করলে সম্যক জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। সম্যক জ্ঞানের জন্য প্রয়োজন সম্যক দর্শন।

তীর্থস্করদের নির্ভরযোগ্য উপদেশ হল সম্যক দর্শন। মোক্ষ লাভের তৃতীয় অপরিহার্য শর্ত হল সম্যক চরিত্র। কামনা, বাসনা, ইন্দ্রিয়, চিন্তা, বাক্য প্রবৃত্তিকে সংযত করা হল সম্যক চরিত্র। সম্যক চরিত্র লাভ করার জন্য কোন কোন জৈন গ্রন্থকার পঞ্চমহাব্রত পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। এগুলো হল- অহিংসা, সত্য, অস্তেয় (চৌর্যবৃত্তি থেকে বিরত থাকা), ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ (বিষয়-আসক্তি পরিহার করা) সম্যক দর্শন, সম্যক জ্ঞান এবং সম্যক চরিত্র- জৈন নীতিশাস্ত্রকারদের মতে এই তিনটি গুণ ত্রিরত্মের সমতুল্য। এই তিনটি গুণের অনুশীলনের দ্বারা জীবের কামনা-বাসনা সংযত হয়, আসক্তি বিদূরিত হয়, কর্ম প্রভাব থেকে আত্মা মুক্ত হয় এবং তখনই জীবের মোক্ষ লাভ ঘটে।


সাংখ্য দর্শন 

সাংখ্য দর্শনের অনুসারীদের মতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে মতদ্বৈততা পরিলক্ষিত হয়। ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে সাংখ্য দার্শনিকদের অনেকে বলেন, জগৎ যেহেতু কার্য, অবশ্যই এর একটা কারণ থাকবে। ঈশ্বর জগতের কারণ নয়, প্রকৃতিই জগতের মূল কারণ।

দ্বিতীয়তঃ প্রকৃতির পরিচালক হিসাবে কোন সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের সত্তা অনুমান করা যুক্তিযুক্ত নয়, কেননা ঈশ্বরের কর্ম প্রবৃত্তির কোন যুক্তিযুক্ত কারণ নেই।

তৃতীয়তঃ কর্মফলের সিদ্ধিদাতারূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা যায় না, কারণ কর্ম স্বাভাবিকভাবে ফল প্রদান করে।

চতুর্থতঃ ঈশ্বর বদ্ধ পুরুষও নন কিংবা মুক্ত পুরুষত্ত নন। বাচস্পতি মিশ্র অনিরুদ্ধের মতেও সাংখ্য দর্শন নিরীশ্বরবাদী। কিন্তু বিজ্ঞানভিক্ষু কোন কোন আধুনিক ব্যাখ্যাকার এর মতে সাংখ্য দর্শন নিরীশ্বরবাদী নয়। বিজ্ঞানভিক্ষু ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেও, ঈশ্বরকে এক আদি পুরুষরূপেই গ্রহণ করেছেন। ঈশ্বর নির্গুণ নিষ্ক্রিয়, কিন্তু গুণময়ী প্রকৃতি ঈশ্বরের সান্নিধ্যে চেতনা লাভ করে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে এবং তারই ফলে জগৎ সৃষ্টি।

সাংখ্য দর্শনে দুটি মূল তত্ত্বকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। তাহল- পুরুষ এবং প্রকৃতি। আত্মাকেই পুরুষ নামে অভিহিত করা হয়। পুরুষ বা আত্মা দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি বা জড় জগতের কোন বস্তু নয়। পুরুষ স্বপ্রকাশ চৈতন্যস্বরূপ। পুরুষ চৈতন্য বিশিষ্ট দ্রব্য নয়। কারণ চৈতন্য বা জ্ঞান পুরুষের ধর্ম বা গুণ নয়। পুরুষই চৈতন্যস্বরূপ বা জ্ঞান স্বরূপ। পুরুষ নিত্য, নির্বিকার, নির্গুণ, শুদ্ধ এবং অপরিনামী। পুরুষ এক নয়, বহু। যদি পুরুষ বা আত্মা বহু হয়ে এক হত তাহলে একজনের জন্ম বা মৃত্যু হলে সকলের জন্ম বা মৃত্যু হত, বা একজনে কোন কাজে প্রবৃত্ত হলে অন্য সকলে সেই কার্যে প্রবৃত্ত হত। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না।

সাংখ্য দর্শনের দ্বিতীয় মূল তত্ত্বটি হল প্রকৃতি। প্রকৃতিই এই জড়জগতের মূল উপাদান কারণ। প্রকৃতি বহ নয়, এক। প্রকৃতি চেতন নয়, জড়। এর আর এক নাম হল অব্যক্ত। ইহা অতি সূক্ষ বিধায় ইন্দ্রিয় গোচর নয় এবং এর আদি বা অন্ত নেই। সত্ত্ব, রজঃ তমঃ এই তিন গুণের সাম্যাবস্থাই প্রকৃতি। এগুলো প্রকৃতির স্বরূপ এবং উপাদান। একখন্ড রজ্জ্ব যেমন তিনটি তার বা গুণের দ্বারা নির্মিত হয়, অনুরূপ জগতের প্রতিটি বস্তু সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিনটি উপাদানের দ্বারা গঠিত হয়। এরা পুরুষের উদ্দেশ্য সাধন করে এবং পুরুষ বা আত্মাকে জগতের সঙ্গে বেঁধে রাখে। জগতের বিভিন্ন বস্তু এইসব গুণগুলাের কার্য এবং কার্য থেকে এদের অস্তিত্ব অনুমান করে নেওয়া হয়। সত্ত্ব, রজঃ তম: এই তিনটি গুণ যথাক্রমে সুখদায়ক, দুঃখদায়ক এবং বিষাদাত্মক। সুখের সর্ববিধ অবস্থা যেমন আনন্দ, প্রীতি, সন্তোষ, উল্লাস প্রভৃতি সত্ত্বগুণের জন্যই বস্তুতে উপস্থিত থাকে। রজঃ গুণ দুঃখ স্বরূপ এবং সকল রকম দুঃখজনক অভিজ্ঞতার কারণ। তা গতিশীল, ক্রিয়াশীল এবং উত্তেজক। তমঃ গুণ বস্তুর নিষ্ক্রিয়তা এবং অসারতার কারণ। ভ্ৰম, প্রমাদ, নিদ্রা, আলস্য, তন্দ্রালুতা প্রভৃতি তমঃ গুণের উপস্থিতির জন্যই উৎপন্ন হয়।

তমঃ গুণের জন্যই মনে নিস্পৃহতা বা বিষাদের সৃষ্টি। এই তিনগুণ সব সময় একত্রে ক্রিয়া করে এবং এদের কখনও পৃথক করা যায় না। জগতে এমন কোন বস্তু নেই যার মধ্যে এই তিনটি গুণ কোন না কোন পরিমানে উপস্থিত নেই গুণগুলোর তারতম্যের জন্যই জগতে এত বৈচিত্র্য।

প্রকৃতি এবং পুরুষের সংযোগের মাধ্যমেই জগতের অভিব্যক্তি শুরু হয়। সক্রিয় প্রকৃতির সঙ্গে চেতন পুরুষের সংযোগ না ঘটলে জগতের অভিব্যক্তি সম্ভব হয় না। দর্শন শক্তি সম্পন্ন পঙ্গু যেমন চলন শক্তি সম্পন্ন অন্ধের স্কন্ধে আরোহণ করে নির্দিষ্ট পথ অতিক্রম করে, ঠিক তেমনিভাবে নিষ্ক্রিয় চেতন পুরুষ এবং সক্রিয় অচেতন প্রকৃতি উভয়ে মিলিত হয়ে জগতের অভিব্যক্তিকে সম্ভব করে তোলে।

সাংখ্য দার্শনিকদের মতে জগৎ দুঃখময়। এই দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিই হল মোক্ষ। দুঃখ নিবৃত্তির পক্ষে লৌকিক বা বৈদিক কোন উপায় পর্যাপ্ত নয়। দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উপায় তত্ত্বজ্ঞান। প্রকৃতি পুরুষের ভেদজ্ঞান হল এই তত্ত্বজ্ঞান। তাদের অভেদজ্ঞানই হল পুরুষের বন্ধন। বিবেক জ্ঞান অর্থাৎ প্রকৃতি পুরুষের ভেদজ্ঞান দুঃখ নিবৃত্তির একমাত্র উপায়। তত্ত্বাভ্যাসের মাধ্যমে বিবেকজ্ঞান লব্দ হয়। ধ্যান, ধারণা, অভ্যাস, বৈরাগ্য প্রভৃতির সহায়তায় দীর্ঘ সুকঠিন যােগ সাধনার মাধ্যমে এই তত্ত্ব জ্ঞান লাভ করা যায়। সকল প্রকার দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিই হল মুক্তি। এমন অবস্থায় সুখ-দুঃখ, কর্তৃত্ব, ভোক্তৃত্ব সব তিরোহিত হয়।

মুক্তি দু’প্রকার। জীবন্মুক্তি এবং বিদেহমুক্তি। তত্ত্বজ্ঞান লাভ হলে জীব মোক্ষ লাভ করে, দুঃখ তাকে আর স্পর্শ করতে পারে। তাকে বলে জীবন্মুক্তি। কিন্তু তখনও শরীর ধারণ চলতে থাকে। মৃত্যুর পর জীবন্মুক্তি বিদেহ মুক্তি লাভ করে। এই অবস্থায় প্রকৃতির নিবৃত্তি হেতু পুরুষ আত্যন্তিক এবং ঐকান্তিক এই দুই প্রকার কৈবল্য লাভ করে। একেই বলা হয় বিদেহ কৈবল্য।

Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.