বৌদ্ধ দর্শনে ঈশ্বর
এবার ঈশ্বর, জগৎ, আত্মা, দুঃখের নিবৃত্তি সম্পকে বৌদ্ধ দর্শনে কি বলে তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
বৌদ্ধ ধর্মে অনুমান করে বা ধারণা করে গ্রহণ করা এমন বিষয়ের স্থান নেই। প্রত্যক্ষ প্রমান সাপেক্ষে যা কিছু পাওয়া যায় তাকেই গ্রহণ করে। এতে লীলাময়ের লীলা, ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা কিংবা দৈব খেয়ালের দোহাই নেই।
কোন অদৃশ্য শক্তি এই বিশ্ব জগৎ, জগতের সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন এমন চিন্তা করাও অযৌক্তিক। যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা না যায় বা সাক্ষ্য প্রমানে পাওয়া যায় ততক্ষণ পর্যন্ত তা আছে এ কথা বলা যাবে না।
অতীত কোন বুদ্ধ কাউকে ঈশ্বর দেখাতে পারেননি, ভবিষ্যতেও কোন বুদ্ধ পারবেন না। যার অস্তিত্ব স্বীকার করা অর্থহীন তাকে কখনো দেখানো সম্ভব নয়। এমন আলোচনা করে অযথা সময় ব্যয় না করার জন্য বলা হয়েছে।
বিশ্বাস করাও মুক্তি মার্গ লাভের অন্তরায়। শাস্ত্রে সাধন কাজে উন্নতি লাভে যে অন্তরায় বা বাধা গুলো আছে তন্মধ্যে এটি একটি বড় ধরনের বাধা। শাস্ত্রে আছে কর্মান্তরায়, ক্লেশান্তরায়, বিপাকান্তরায়, উপবাদান্তরায় এবং আদেশ অমান্য অন্তরায়। কেহ যদি মনে করে, এ জগতের স্থাবর-জঙ্গম যত সম্পদ, যত জীবিত সত্ত্বা, চন্দ্র- সূর্য, গ্রহ নক্ষত্রাদি যাবতীয় পর্দাথের সৃষ্টির মূলে কোন হেতু নেই, প্রত্যয় নেই।
কোন ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা শক্তিতে সর্ব প্রকার পর্দাথের সৃষ্টি ও বিলয় হয়ে থাকে। জাগতিক সবকিছু হেতু প্রত্যয় বিহীন-এরূপ ধারনাকে অহেতুক দৃষ্টি বলে যা ক্লেশান্তরায়ের অন্তর্গত।
বুদ্ধের ধর্ম কর্মবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। যে যেমন কর্ম করবে সে তেমন ফল ভোগ করবে। বুদ্ধ বলেছেন-
“কম্মসৃসকা মানবকসত্তা, কম্মদায়াদা কস্মযোনি
কম্মবন্ধু, কম্ম পটিসরণা, যং কম্মং করিসন্তি,
কল্যানং বা পাপকং বা তস্স দাদা ভবিস্সন্তী’তি
কম্মং সত্তে বিভজতি যদিদং হীনপ্পনী তত্তা যাযতি।“
বুদ্ধের অনাত্মবাদ
জীবগণ সবকৃত কর্মই ভোগ করে, স্বীয় কর্মের উত্তরাধিকারী হয়, কর্মমতেই যযানি গ্রহণ করে। কর্ম নিজের বন্ধু এবং কর্মই নিজের আশ্রয় স্বরূপ, কল্যাণ বা পাপ যে, যেই কর্ম করবে সে সেই কর্মের উত্তরাধিকারী হবে। কর্মই জীবগণকে হীন ও শ্রেষ্ঠ রূপে বিভাগ করে।
অন্য মতবাদে উক্ত আছে, তুমি কর্ম কর, তবে কোন ফলের আশা করো না, কারণ ফল প্রদানের মালিক ঈশ্বর বা গড। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মে এমন। বিশ্বাস করা মিথ্যাদৃষ্টির পর্যায়ভুক্ত।
কোন কিছু প্রত্যাশা করলে এবং সেই ভাবে চেষ্টা করলে তা প্রাপ্তি ঘটে। আর যদি পাওয়ার জন্য চেষ্টা না করা হয় তা হলে পাওয়া যাবে না। এস.এস.সি পরীক্ষার সফলতার মানসিকতা নিয়ে উদ্যম চালিয়ে যাওয়া ছাত্রই সফলতা নিয়ে আসে। কর্মতত্ত্ব বিশ্লেষণে পাওয়া যায় অপর পৰ্য্যায় বেদনীয় কর্ম এবং অকুশল গুরু কর্ম ব্যতীত অন্য সর্ব প্রকার কর্ম যথাকালে ফল প্রদানে ব্যর্থ হলে তা অহহাসি কর্মে পরিণত হয়, অর্থাৎ পরবর্তীতে আর ফল প্রদান করার সক্ষমতা থাকে না।
তাই উল্লেখিত দুই কর্ম ব্যতীত অন্যান্য কুশল কর্মের ক্ষেত্রে ফলোৎপাদনের চেষ্টা, সেরকম পরিবেশ সৃষ্টি অব্যাহত রাখতে হয়, যেহেতু কুশল কর্মের পরিণাম সুখকর। অহোসি হলে সেই সুখ আর পাওয়া গেল না। অকুশল কর্মের ক্ষেত্রে তা যাতে ফলোৎপাদন করতে না পারে এমন চেষ্টা, সেরকম পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়, যেহেতু অকুশল কর্মের পরিণাম দুঃখজনক।
নির্দিষ্ট সময় অন্তে এ কর্ম অক্ষম হয়ে যায়। তখন আর দুঃখ ভোগ করতে হবে না। মনে করুন যুবক সংসার জীবনে প্রবেশ না করে প্রব্রজ্যা ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ব্রহ্মচর্য জীবন অতিবাহিত করতে লাগল। সংসার ত্যাগ করে ধর্ম শাস্ত্র অধ্যয়ন করে পান্ডিত্য অর্জন করল। ধ্যান সাধনা অনুশীলন করে অনেক গুণের অধিকারী হল। তার যশ-খ্যাতি, সম্মান, গৌরব সর্বদিকে প্রবাহমান।
এখানে বলা যায় যুবকের অতীত জীবনের নৈক্কম্য পারমীর শক্তি আছে এবং এ জন্মে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বিধায় অতীত কর্ম যোগ হয়ে ব্রহ্মচর্য সুখ সম্মান উপভােগ করতেছে। অতীত নৈম্য পারমীর শক্তি থাকলেও যদি এজন্মে সংস্যার ত্যাগের চেষ্টা না থাকত তবে অতীত কর্ম ফল দেওয়ার সুযোগ পেত না। যার কারণে নির্দিষ্ট সময় অন্তে তা অহােসি কর্মে পরিণত হত।
আবার যুবক সংসার ধর্মে প্রবেশ করলে এখানে যে দুঃখ আছে এর সাথে অতীত পাপ কর্ম যোগ হয়ে দুঃখ গুলো আরো বেশী করে ভোগ করতে হয়।
আর পূর্বের পাপ কর্ম থাকলেও বৈরাগ্য জীবনে অতটুকু দুঃখ দেবার সুযোগ সে খুজে পায় না। কাজেই সুখ ভোগ করার এবং দুঃখ প্রতি হত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হয়। নিজের প্রচেষ্ঠাতেই তা লাভ এবং ত্যাগ করা যায়। এতে ঈশ্বরের কোন হাত নেই। সুতরাং নিজে কর্ম করলে ঈশ্বর বা কোন অদৃশ্য শক্তি ফল প্রদান করবে এমন বিশ্বাস অন্তরায় এর পর্যায় ভুক্ত। আর অপর পৰ্য্যায় বেদনীয় কর্ম এবং অকুশল গুরু কর্মের ফল নিয়ম অনুযায়ীই কর্তার নিকট উপস্থিত হয়, এতে ঈশ্বরের কোন হাত নেই।
একটি জীবন প্রবাহের আদি সীমা কোথায় একথা বলা দু:সাধ্য। সংযুক্ত নিকায়ের “তৃণকাষ্ট সূত্র” তে বুদ্ধ ভিক্ষুগণকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, হে ভিক্ষুগণ, এই সংসারের আদি অবিদিত (অজানা)। অবিদ্যা-নীবরণ ও তৃষ্ণা সংযোজনে আবদ্ধ, সংসারবর্তে ধাবমান, সংসরণকারী সত্ত্বগণের পূর্বান্ত দেখা যায় না। যেমন, কেন ব্যক্তি এই জম্বুদ্বীপে যতোসব তৃণকাষ্ট, শাখা-পল্লব আছে সেগুলো একস্থানে স্তুপ করে চার আঙ্গুল চার আঙ্গুল প্রমান গুটি করে এটা আমার মাতা, আমার সেই মাতার ইনিই মাতা' বলে এক একটি গুটি নিক্ষেপ করে। ভিক্ষুগণ, তাহলে এই জম্বুদ্বীপের সমস্ত তৃণকাষ্ট, শাখা পল্লব শেষ হয়ে যাবে, তবুও সেই ব্যক্তির মাতা ও মাতার জননীর সংখ্যা শেষ হবে
না। তার কারণ ভিক্ষুগণ, এই সংসারের আদি অবিদিত। অবিদ্যা-নীরবণ তৃষ্ণা-সংযোজনে আবদ্ধ সংসারবর্তে ধাবমান, সংসরণকারী সত্বগণের পূর্বান্ত দেখা যায় না। এভাবে তোমরা সুদীর্ঘকাল তীব্র দুঃখ ও ধ্বংসলীলা অনুভব করেছ আর শ্মশান বৃদ্ধি করেছ। তদ্ধেতু তোমাদের সর্ব সংস্কারের প্রতি উদাসীন, অনাসক্ত এবং বিমুক্ত হওয়া উচিৎ।
“পৃথিবী সূত্র”তে বুদ্ধ বলেছেন-হে ভিক্ষুগণ, কোন ব্যক্তি এই মহাপৃথিবীকে বড়ই বিচি প্রমান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোলক বানিয়ে এটি আমার পিতা, আমার সেই পিতার ইনিই পিতা বলে একটি একটি করে গোলক নিক্ষেপ করে তাহলে মহাপৃথিবী শেষ হয়ে যাবে তবুও সেই ব্যক্তির পিতা ও পিতার পিতা সংখ্যা ফুরাবে না। তার কারণ এ সংসারের আদি অবিদিত। অবিদ্যা-নীবরণ
ও তৃষ্ণা সংযোজনে আবদ্ধ সংসারাবতে ধাবমান, সংসরণকারী সত্ত্বগণের পূর্বান্ত (শুকুটা) দেখা যায় না। ভিক্ষুগণ, এভাবে তোমরা সুদীর্ঘকাল তীব্র দুঃখ ধ্বংসলীলা অনুভব করেছ আর শ্মশান বৃদ্ধি করেছ, তদ্ধেতু তোমাদের সর্ব সংস্কারের প্রতি উদাসীন, অনাসক্ত এবং বিমুক্ত হওয়া উচিৎ ।
“চর্মদড়িবদ্ধ সূত্র” তে বুদ্ধ সত্ত্বগণের পূর্বকোটি (শুরুটা) যে দেখা যায়
না তা উল্লেখ করেছেন। একজন সম্যক সম্বুদ্ধ ইচ্ছা করলে শত সহস্র কল্পের অতীত বিষয়ও চিন্তা করে বের করতে পারেন। এরপরও দেখা যায় জীবন প্রবাহগুলো বর্তমান। কাজেই আদি সীমা নির্ধারণ করা যায় না। বুদ্ধকে যখন আদি সীমা সম্পকে সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হত তখন তিনি একটি উপমা দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন।
উপমাটি হল- যিনি প্রশ্ন করতেন তাকে উপলক্ষ্য করে বুদ্ধ বলতেন, মনে কর দুর হতে একটি শর তোমার শরীরে বিদ্ধ হল। নিকটে যে সকল লোকজন আছে এরা দৌড়ে এসে তোমার শরীরে বিদ্ধ শর তুলতে আসল। তখন তুমি তাদেরকে যদি বল, আমার আপনাদের প্রতি কিছু প্রশ্ন আছে। এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া ব্যতীত আমার শরীর থেকে শর উত্তোলন করবেন না। প্রশ্নগুলো হল, যিনি আমাকে শর দ্বারা আঘাত করেছেন তিনি কি হিন্দু ধর্মের লোক? নাকি মুসলিম, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন, ইহুদী ইত্যাদি। তিনি বাংলাদেশী নাকি ইন্ডিয়ান, বারমীজ, শ্রীলংকান, পাকিস্তানী, জাপানী, নেপালী ইত্যাদি। সেই লোক কি শ্বেতাঙ্গ? নাকি কৃষ্ণাঙ্গ। লম্বা? নাকি বেটে । পায়ে জুতা ছিল? নাকি ছিল না। মহিলা? নাকি পুরুষ। মহিলা হলে চুল লম্বা ছিল? নাকি বেটে ছিল। শাড়ী পড়া ছিল? নাকি অন্য কোন পোশাক ছিল। গায়ে বোরকা ছিল? নাকি ছিল না। হাতে শাখা ছিল? নাকি ছিল না।
ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রশ্ন করে এর উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত দেহ থেকে শর উত্তোলন না করার জন্য বললেন। এখন আগে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর অন্বেষণ করা কি উচিৎ হবে? নাকি আগে দেহ থেকে শর উঠানো উচিৎ হবে। সাধারণ অল্প জ্ঞানী মানুষও এর উত্তর দিতে পারবেন যে, আগে শরীর থেকে শর উঠানো উচিৎ হবে। কারণ শরীরে শর রেখে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে তার জীবনান্তও ঘটতে পারে। অনুরূপ আমরা সকলে কর্ম সদৃশ শর দ্বারা আহত। লোভ, দ্বেষ , মোহ থেকে উৎপন্ন দুঃখ দ্বারা সর্বদা পেষিত হচ্ছি। সেই দুঃখ জ্বালা সহ্য করতে না পেরে সাময়িক নিষ্কৃতি ভেবে বিষপানে, গাছের ডালে ঝুলে, গাড়ীর নীচে পড়ে, গায়ে আগুন দিয়ে, পানিতে ঝাপ দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে নিজেকে আঘাত করে, বিভিন্নভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছি।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছে-
এ সংকটময় কর্ম জীবন
মনে হয় মরু সাহারা
দূরে মায়াপুরে দিতেছে দৈত্য পাহারা
তবে ফিরে যাওয়া ভাল তাঁহাদের পাশে
পথ চেয়ে আছে যাহারা।
এ জীবন সংকটময়, বিপদ সংকুল, সাহারা মরুভূমি সদৃশ। গাছ-
পালা, পত্র পল্লবহীন মরুভূমিতে যেমন কোন পথিক বহ্নির তপ্ত তেজে দগ্ধিভূত হয়ে পথ অতিক্রম করতে হয়, দ্রুপ প্রাণীকুল কন্টকাকীর্ণ জগতে কামাগ্নি, দ্বেষাগ্নি, মোহাগ্নিতে অংগার হতে হতে সময় অতিবাহিত করছে। এই বিষাক্ত শরগুলোর তাড়নায় প্রাণীকুল অস্থির। পাশেই আছে দানব সদৃশ মরনাগ্নি।
যিনি সেই দানব থেকে রেহাই পেতে শর জ্বালার সাথে যুদ্ধ করে মহাপুরুষগণের রচিত পথ ধরে অগ্রসর হন তিনিই চির শান্তির রাজ্যে গমন করতে পারেন। কোন অগ্নি তখন আর তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি সংগ্রাম জয়ী। কোন শর দ্বারা আর আহত বা নিহত হবেন না।
আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত লোকোত্তর ধর্মে অধিষ্ঠিত হতে না পারি ততক্ষণ পর্যন্ত বাণবিদ্ধ। এখান থেকে নিষ্কৃতি চাই। নিষ্কৃতি পেতে হলে সম্যক পথে অগ্রসর হতে হবে। সম্যক পথ হল অষ্টাঙ্গ পথ। সেই পথ না ধরে যদি ঈশ্বর, আত্মা, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চিন্তা করি, তর্কে জড়িয়ে পড়ি এর কোন সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। আগে বীজের সৃষ্টি, নাকি বৃক্ষের সৃষ্টি, এই প্রশ্নের কোন সমাধান নেই। আগে ডিমের সৃষ্টি, নাকি হাঁসের সৃষ্টি, এই প্রশ্নের সমাধান কোন যুগেও সম্ভব নয়।
প্রত্যেকটি বস্তু, ঘটনার পিছনে দুইটি সত্য লুকায়িত থাকে। একটি হল জাগতিক সত্য এবং অপরটি হল পরমার্থিক সত্য। দুইটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলে ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধা হবে। মনে করুন রনজিৎ বাবুর দুই ছেলে অঞ্জন এবং রঞ্জন। তারা রনজিৎ বাবুর ঔরসজাত সন্তান, পিতা পুত্র সম্পক। কিন্তু এই সম্পর্ক হল জাগতিক সত্য, পরমার্থিক সত্য নয়। পরমার্থিক সত্যে বলা যায় এ জগতে কেউ কারো নয়। আজকে আমার ছেলে, আমার মেয়ে, আমার স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত যা কিছু বলা হোক, আগামীদিন সেগুলো আর আমার থাকবে না। আমার শরীরও আমার নয়। রনজিৎ বাবুর অনন্ত জন্মের অনন্ত ছেলে-মেয়ে। এখন কেউ আর আপন হয়ে রইল না। সকলেই জগতের চিরন্তন প্রবাহের মাঝে মিশে গেল । এটাই হল পরমার্থিক সত্য।
আর একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, যেমন, Water has no colour, অর্থাৎ পানির কোন রং নেই। অথবা পানির গতি নিম্নমুখী। পানি যে
পাত্রে রাখা হয় সেই পাত্রের আকার ধারণ করে। অথবা পানি অগ্নি নির্বাপক। প্রজ্বলিত অগ্নি পানি দিয়ে নিভানো হয়। ইত্যাদি পানির ধর্ম গুলো হল জাগতিক সত্য বা বাহ্যিক সত্য। কিন্তু পরমার্থিক সত্য হল হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনে পানি সৃষ্টি হয়। আবার পানিতে তড়িৎ সংজোযিত হলে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন পরিণত হয়। পানির গুণাগুণ থেকে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের গুনাগুণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। পানি অতিরিক্ত তাপে বাষ্পে পরিণত হয়। আবার অতি ঠান্ডায় তা বরফে পরিণত হয়। বাষ্প এবং বরফের ধর্ম থেকে পানির ধর্ম সম্পূর্ণ পৃথক। এভাবে জগতের প্রতিটি বস্তু এক অবস্থায় এক অবস্থানে থাকে না। ক্ষণে ক্ষণে তা পরিবর্তন হচ্ছে। জীব জগৎ, জড় জগৎ, প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি বিষয়ে চলছে পরিবর্তনশীলতা, অস্থিরতা, গতি প্রবাহ।
বৌদ্ধ দর্শনের ভাষায় একেই বলে অনিত্য, যা পরমার্থিক সত্য। প্রতিটি বস্তু, ঘটনাতে এই দুই সত্যই বিরাজমান। সাধারণভাবে চর্ম চক্ষুতে যে অবস্থা দৃষ্টি গোচর হয় তা হল বাহ্যিক সত্য। আর প্রজ্ঞা চক্ষুতে যে অবস্থা অনুভূত হয় তা পরমার্থিক সত্য। পরমার্থিক সত্য উপলব্দ ব্যক্তি আর শর দ্বারা আহত হন। অর্থাৎ কামাগ্নি, মোহাগ্নি তাকে স্পর্শ করতে পারে না। উনিই বিভিন্ন প্রশ্নের সমাধান। তাই অন্তরায় মূলক বিভিন্ন প্রশ্নে নিজের মাঝে অস্থিরতা সৃষ্টি না করে পরমার্থিক সত্যে অবগাহন করা উচিৎ।
বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য আরো কিছু কথা বলতে হয়। একজন তরুণ ভিক্ষু পিন্ডাচরণে বের হলেন। পিন্ডাচরণ করার সময়ে এক ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়ীর সম্মুখে উপস্থিত হতেই এই বাড়ীর এক যুবতী কন্যা অন্ন ভিক্ষা দেওয়ার জন্য অন্নে ভর্তি পাত্র হাতে করে ভিক্ষুর নিকট উপস্থিত হলেন। সামনে দাঁড়িয়ে ভিক্ষুকে উপলক্ষ্য করে দুটি প্রশ্ন করলেন। সেই তরুণ ভিক্ষু জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন দুটির যথাযথ উত্তর দিলেন। তাদের প্রশ্নোত্তর হল নিম্নরূপ-
কন্যা- অকালে কেন সকাল?
ভিক্ষু- রাস্তা বহু দুর ।
কন্যা- তরঙ্গ’ত বড়?
এবার প্রশ্ন এবং উত্তরের মাঝে কি মর্মার্থ লুকায়িত আছে এর অনুসন্ধান করা যাক। কন্যার প্রশ্নের তাৎপর্য হল - ভিক্ষু অল্প বয়সী। এ বয়সে সাধারনত মানুষ সংসারের প্রতি মোহিত হয়ে থাকে। সংসারের কামসুখ ভোগ করার পর বৃদ্ধ বয়সে সন্ন্যাসী হয়ে ধর্মচর্চা করা যেতে পারে। তাই এ বয়সে ধর্ম অনুশীলন করার সময় এখনও হয়নি। কিন্তু ভিক্ষু উত্তর দিলেন, রাস্তা বহু দুর। উত্তরের মমার্থ হল- সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা সহজ সাধ্য নয়। অনন্ত জন্ম সাধনা করে ত্রিশ প্রকার পারমী পূর্ণ করে সিদ্ধি লাভ করতে হয়। সেজন্য প্রয়োজন সীমাহীন ত্যাগতিতিক্ষা, সংযম, ধৰ্য্য, সহিষ্ণুতা, অনন্ত কল্প চক্রবালে পরিভ্রমন করে অপ্রমাদের সহিত সাধনা করে মুক্তি লাভ করতে হয়। একবার অপায়ে পতিত হলে জগতে কত বুদ্ধ অতীত হয়ে যাবেন কিন্তু ধর্ম পুণ্য করা সম্ভব হবে না। আবার সকল দেব-ব্রহ্মলোকেও ধর্মপুণ্য করার সুযোগ থাকে। সেখানে উৎপন্ন হলে কত কল্প সময় চলে যায় মুক্তি লাভ করার সুযোগ সৃষ্ঠি হয় না। কাজেই মানুষ হয়ে যখন জন্ম গ্রহণ করেছি সময় থাকতে সাধন করে পথের সীমা কমিয়ে আনতে হবে অর্থাৎ নির্বাণ লাভের দিকে অগ্রসর হতে হবে। তাই ভিক্ষু বলেছেন দুর রাস্তা পাড়ি দিতে অল্প বয়সেই কঠোর উদ্যমে যাত্রা শুরু করতে হবে।
কন্যার দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল তরঙ্গ’ত বড়? তরঙ্গ এর অভিধান গত অর্থ হল উর্মি বা ঢেউ। কিন্তু এখানে পঞ্চকামগুণ সমন্বিত জগতের রূপ-
চাকচিক্যময় অবস্থাকে বুঝানো হয়েছে। জগতের মানুষ কামমুখী। সকলে ভোগ বাসনায় মত্ত থাকে। ভবিষ্যৎ জীবনকে কেন্দ্র করে অল্প বয়সী ছেলে মেয়েরা কত রকম কামময় কল্পনার আল্পনা অংকন করে। কামনা বাসনার মোহে চাঞ্চল্য জীবন। এমন পরিবেশকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বিরাগ ধর্মের সাধন করা খুবই কষ্টকর।
ভিক্ষু দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বললেন - মাঝিত্ত অতি দড়। তার জীবন দরিয়ার রূপ তরুণীতে নিজেকে মাঝি হিসাবে কল্পনা করেছেন। ভব সমুদ্র পাড়ি দিতে ভিক্ষু মাঝি সদৃশ। আর দড় অর্থ দক্ষ, মজবুত, শক্ত, পারদর্শী ইত্যাদি। ভিক্ষুর কথা হল, জগৎ সমুদ্রে তরঙ্গ যত বড় হোক না কেন সে অতি দক্ষতার সহিত শক্ত হাতে তা প্রতিহত করে গন্তব্যস্থলে পৌছতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ চারি পাশে পঞ্চকামগুণের বিষয়াদি যতই থাকুক না কেন সে এগুলোকে দমিত করে অভীষ্ট লক্ষে পৌছতে তার কোন সমস্যা হবে না। তাই প্রয়োজন অল্প বয়সে সন্ন্যাস জীবন আচরণ করা। অষ্টাঙ্গ মার্গ অনুশীলন করা।
সুতরাং যে বিষয়ের কোন সমাধান নেই এমন চিন্তা পরিহার করে কিভাবে সুখ-শান্তি-নিষ্কৃতি পাওয়া যায় এমন কাজই করা উচিৎ। কর্ম তৎপরতাকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ অদৃশ্য শক্তির উপর নির্ভরশীল না হয়ে সেই ভিক্ষুর মত প্রমাদবিহীন ভাবে নির্বানমুখী কর্ম করা প্রত্যেকের কর্তব্য।
সূত্র পিটকের দীর্ঘ নিকায় গ্রন্থের ‘পাঠিক সূত্র’তে উল্লেখ আছে, ভগবান এক সময় মল্লদিগের দেশে অনুপিয় নামক নগরে অবস্থান করছিলেন। তথায় একদিন ভগব-গোত্ত পরিব্রাজকের আরামে তার সাথে দীর্ঘক্ষণ আলাপান্তে তাকে সম্বোদন করে বললেন-ভগগব, বস্তুসমূহের (জগতের সকল বিষয়াদি) প্রারম্ভ আমি অবগত আছি, শুধু তাহাই নয়, তাহা অপেক্ষা অধিক আমার বিদিত। কিন্তু ঐ জ্ঞান আমাকে স্ফীত করে না, উহা দ্বারা অস্পৃষ্ট হয়ে আমি স্বীয় অন্তরে মুক্তি অনুভব করি, সে অনুভূতির নিমিত্ত তথাগত দু:খে নিপতিত হন না। ভগগব কোন কোন শ্ৰমণ ও ব্রাহ্মণ আছেন যারা তাদের শিক্ষানুসারে ঘোষণা করেন যে বস্তুসমূহের প্রারম্ভ ঈশ্বর অথবা ব্রহ্মার লীলা। আমি তাদের নিকট গমন করে বলি, সত্যই কি আপনারা ঘোষণা করেন যে আপনাদের শিক্ষানুসারে বস্তুসমূহের প্রারম্ভ ঈশ্বর, অথবা ব্রহ্মার লীলা? এরূপ জিজ্ঞাসিত হয়ে তারা বলেন, “ইহা সত্য। আমি তাদেরকে বলি, আপনারা কিরূপে নির্ধারণ করেন যে বস্তুসমূহের প্রারম্ভ ঈশ্বর অথবা ব্রহ্মার লীলা? আমি এরূপ জিজ্ঞাসা করলে তারা উত্তর দিতে সমর্থ না হয়ে আমাকে প্রতি প্রশ্ন করেন। তখন আমি উত্তর করি, বন্ধুগণ, এমন সময় আসে যখন, আজই হোক কিংবা আগামী দিন হোক, দীর্ঘ কাল অতীত হবার পর এ জগৎ লয় (নাশ) প্রাপ্ত হয়। এরূপ সময়ে জীবগণ বহুল পরিমানে আভাস্বর (ব্রহ্মলোকজগতে পুনর্জন্ম লাভ করে। তারা তথায় মনোময় হয়ে থাকে, প্রীতি তাদের ভক্ষ্য স্বরূপ হয়, তারা স্বয়ংপ্রভ, অন্তরীক্ষচর ও শুভস্থায়ী হয়ে সুদীর্ঘকাল অবস্থান করে। এমন সময় আসে, যখন, আজই হোক কিংবা আগামীদিন হোক, দীর্ঘকাল অতীত হবার পর এ জগতের বিবর্তন (ক্রমবিকাশ) হয়। ঐ সময় শূন্য ব্রহ্মবিমান প্রাদুর্ভূত হয়। কোন সত্ত্ব আয়ুক্ষয় বা পুণ্যক্ষয়ের নিমিত্ত আভাস্বর জগৎ হতে চ্যুত হয়ে শূন্য ব্রহ্মবিমানে পুনরায় উৎপন্ন হয়। সে তথায় মনোময় হয়ে থাকে, প্রীতি তার ভক্ষ্য হয়, সে স্বয়ংপ্রভ, অন্তরীক্ষচর এবং শুভস্থায়ী হয়ে দীর্ঘকাল অবস্থান করে। দীর্ঘকাল তথায় একাকী বাস করে তার মনে অসন্তুষ্টি ও ভয়ের উৎপত্তি হয়,” হায়, যদি অপর জীবগণও এস্থানে আগমন করত। “ঐ সময়ে অন্য জীবগণও আয়ুক্ষয় কিংবা পুণ্যক্ষয় বশত আভাস্বর লোক হতে চ্যুত হয়ে তার সঙ্গীরূপে ব্রহ্মবিমানে উৎপন্ন হয়। তারাও তথায় মনোময় হয়ে থাকে, প্রীতি তাদের ভক্ষ্য হয়, তারা স্বয়ংপ্রভ, অন্তরীক্ষচর এবং শুভস্থায়ী হয়ে সুদীর্ঘকাল অবস্থান করে।
বন্ধুগণ, তদনন্তর প্রথমোৎপন্ন সত্ত্ব এরূপ চিন্তা করলেন, “আমি ব্রহ্মা, মহাব্রহ্মা, অভিভূ, অনভিভূত, সর্বদর্শী, সর্বশক্তিমান, ঈশ্বর, কর্তা, নির্মাতা, শ্রেষ্ঠ, স্রষ্টা, ভূত ও ভব্যের শক্তিমান পিতা। জীবগণ আমা কর্তৃক সৃষ্ট।” কী কারণে? পূর্বে আমি এরূপ চিন্তা করেছিলাম, “অহো, অন্য জীবগণও এস্থানে আগমন করুক। আমার এ প্রার্থনায় এ সকল সত্ত্ব এখানে আগমন করেছেন।” পশ্চাদুৎপন্ন সত্ত্বগণও এরূপ চিন্তা করে, “ইনি ব্রহ্মা, মহাব্রহ্মা, অভিভূ, অনভিভূত, সর্বদর্শী, সর্ব শক্তিমান, ঈশ্বর, কর্তা, নির্মাতা, শ্রেষ্ঠ স্রষ্ঠা, ভূত ও ভব্যের শক্তিমান পিতা। আমরা এ ব্রহ্মা কর্তৃক সৃষ্ট। কী হেতু? আমরা তাকেই প্রথমোৎপন্ন জীবরূপে দেখেছি, আমরা ইহার পশ্চাতে উৎপন্ন।”
বন্ধুগণ, অত:পর যিনি প্রথমে উৎপন্ন হয়েছিলেন, তিনি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘায়ু, সৌন্দর্য ও পরাক্রমশালী। যারা পশ্চাতে উৎপন্ন হয়েছিলেন, তারা অপেক্ষাকৃত অল্পাযু, অল্প সৌন্দর্য ও পরাক্রমশীল। তৎপরে বন্ধুগণ, ইহা সম্ভব যে কোন এক সত্ত্ব ঐ স্থান হতে চ্যুত হয়ে এই জগতে আগমন করে। এখানে আগমন করে তিনি গৃহবাস পরিত্যাগ করে অনাগারীত্ব অবলম্বন করেন। তৎপর তিনি উৎসাহ, উদ্যোগ, অনুযোগ, অপ্রমাদ, সম্যক চিন্তার দ্বারা এরূপ চিত্ত সমাধি প্রাপ্ত হন যে, সমাধি অবস্থায় উক্ত পূর্বনিবাস স্মরণ করেন, কিন্তু তৎপূর্ববর্তী জন্ম স্বরণ করতে অক্ষম হন। তিনি এরূপ বলেন, “সেই মহিমাময় ব্রহ্মা, মহাব্রহ্মা, অভিভূ, অনভিভূত, সর্বদর্শী, সর্বশক্তিমান, ঈশ্বর, কর্তা, নির্মাতা, শ্রেষ্ঠ স্রষ্ঠা, ভূত ও ভব্যের শক্তিমান পিতা- যাহা কর্তৃক আমরা সৃষ্ঠ হয়েছি, তিনি নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত, অপরিনামধর্মী। তিনি অনন্ত কাল ঐরূপে অবস্থান করবেন। কিন্তু সেই ব্রহ্মা কর্তৃক সৃষ্ঠ আমরা অনিত্য, অধ্রুব, অল্পায়ু, পরিবর্তনশীল হয়ে এই লোকে আগমন করেছি।”
বন্ধুগণ, ইহাই আপনাদের শিক্ষানুসারে বস্তুসমূহের প্রারম্ভরূপে কথিত ঈশ্বর অথবা ব্রহ্মার লীলা। তদুত্তরে তারা বলেন, সৌম্য গৌতম, আপনি যা বলেছেন, আমরাও এরূপ শুনেছি।
কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ।