Type Here to Get Search Results !

চতুরার্যসত্য দর্শন

চতুরার্যসত্য দর্শন


চতুরার্যসত্য দর্শন

আর্যসত্য বলতে চারি আর্যসত্যকে বুঝায়। গৌতম বোধিসত্ত্ব জীব-জগতের দুঃখের কথা চিন্তা করে তা থেকে পরিত্রাণের জন্য ছয় বৎসর সাধনা করে এই আর্যসত্য দর্শন করেছিলেন। তবে তার সাধনা শুধু ছয় বৎসর নয়। অনন্ত চক্রবালে অনন্ত জীবকুলে সাধনার সাফল্য হল চারি আর্যসত্য

জগৎ দুঃখময়। সুখের মাত্রা একেবারে নগন্য বিদ্যুৎ চমকানোর মত। অনন্ত সময়ের মাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর সময়টুকু যেমন অতি ক্ষুদ্র, একটি জীবনে সুখের মাত্রাও অনুরূপ। জীবনের বাকী সময়টুকু দুঃখে পরিপূর্ণ। যেন দুঃখের সমুদ্র। জননী জঠর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ দুঃখের ঘনান্ধকারে ডুবে থাকে। সংসারে সাময়িক সুখ থাকলেও এই ক্ষণস্থায়ী সুখের পরিনামও দুঃখজনক অদূরদর্শী মূঢ় ব্যক্তির নিকট কোন কোন সময় দুঃখ সুখরূপে প্রতিভাত হয়

অমধুরং মধুরূপেন পিযরূপেন অপ্পিযং,

দুখং সুখস্স রূপেন পমত্তং অতিবত্ততি।(alert-success)

অমধুর মধুররূপে, অপ্রিয় প্রিয়রূপে এবং দুঃখ সুখরূপে অজ্ঞানীর নিকট মনে হয় সুতরাং সাময়িক সুখও দুঃখ জনক।

বুদ্ধের ধর্ম শুধু দুঃখবাদ নয়, দুঃখান্তবাদও গৌতম বুদ্ধ সেই দুঃখের অন্ত সাধন করেছিলেন আজ থেকে আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে চতুরার্য সত্য উপলব্দি করে। ইহাই একমাত্র মুক্তি মার্গ। 

তিনি বলেছিলেন, “চতুসচ্চ বিনিমুত্তো ধম্মো নাম নত্থিঅর্থাৎ চতুরার্য সত্য ব্যতীত অপর কোন ধর্ম নেই। 

পৃথিবীতে অনেক শাস্ত্র, অনেক মতবাদের প্রচলন আছে। যে শাস্ত্রে বা যে মতবাদে চতুরার্য সত্যের উল্লেখ নেই সেখানে আসক্তি ক্ষয়ের কথাও নেই। যেখানে চতুরার্য সত্যের উল্লেখ আছে সেখানে আসক্তি ক্ষয় অর্থাৎ মুক্তি মাৰ্গ আছে চতুরার্যসত্য নিম্নরূপ-

  • ১. দুঃখ আর্যসত্য
  • . দুঃখের কারণ আর্যসত্য
  • . দুঃখ নিরোধ আর্যসত্য
  • . দুঃখ নিরোধের উপায় আর্যসত্য

দুঃখ আর্যসত্যঃ

দুঃখ বহু প্রকার যেমনজন্ম দুঃখ, বার্ধক্য দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, শোক, ক্লেশ, উদ্বেগ, আকাঙ্খা দুঃখ, অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ, প্রিয় বিয়োগ দুঃখ, ইপ্সিত বস্তুর অপ্রাপ্তিতে দুঃখ সংক্ষেপে আসক্তি এই দেহ-মন সমন্বয়ে গঠিত জীবনটাই দুঃখময়।

জন্ম গ্রহণ বলতে সত্ত্বগণের নিজ নিজ সত্ত্বনিকায়ে জন্ম, পুনঃপুনঃ উৎপত্তি, পঞ্চস্কন্ধের আবির্ভাব, ষড়ায়তনের আবির্ভাব বুঝায়।

বার্ধক্য হল প্রাণীগণের পরিপূর্ণ বয়স অতিক্রমে দেহের জীর্ণতা, দত্তাদির পতিতাবস্থা, চর্মের শিথিলতা, কেশ শ্বশ্রুর জীর্ণতা, ইন্দ্রিয় পরিপক্কতা ইত্যাদি অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া বুঝায়

শরীর মাত্রই ব্যাধির আবাস। বিবিধ প্রকার রোগ, ক্ষুধা প্রভৃতি নানা প্রকার ব্যাধি মানুষের উৎপন্ন হয়।

মরণ বা মৃত্যু বলতে নিজ নিজ সত্ত্ব নিকায় হতে চ্যুতি, ভেদ, অন্তর্ধান, পরিত্যাগ ইত্যাদি বুঝায়।

শোক হল আন্তরিক কষ্ট, অন্তর দাহ তা ধন-সম্পদের বিনাশ, আত্মীয়-স্বজনের বিয়োগ, রোগ-ব্যাধি প্রভৃতি কারণে উৎপন্ন হয়।

ক্লেশ বলতে শাস্ত্রে লোভ, দ্বেষ, মোহ, মান ইত্যাদি দশ প্রকার ক্লেশ এবং ওভাস, প্রীতি, প্রশ্রদ্ধি ইত্যাদি বহু প্রকার উপক্লেশ আছে যা সত্ত্বগণকে দুঃখকষ্ট প্রদান করে থাকে।

অপ্রিয় সংযোগ অর্থ যা আমার প্রিয় নয় এর সাহচর্য লাভ যে ব্যাক্তি বা প্রাণীর পরশে আমার অশান্তির সৃষ্টি হয় তবুও এর সান্নিধ্য বা স্পর্শ ঘটার কারণে দুঃখ উৎপন্ন হয়

প্রিয় বিয়োগ হল মা- বাবা, স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এর বিয়োগ, বিচ্ছেদ বা নিজের প্রিয় বস্তু অর্থ-বিত্ত পরিহানিতে দুঃখ উৎপন্ন হয়

ইপ্সিত বস্তুর অপ্রাপ্তিতে দুঃখ সৃষ্টি হয়। মানুষের আশার শেষ নেই একটি চাহিদার তৃপ্তি হলে অন্য চাহিদা সেই স্থান পূরণ করে।

মানুষের অন্তরে আশার নদী চির প্রবাহমান আশানুরূপ বস্তু বা বিষয় অলাভে দুঃখ এসে উপস্থিত হয়। 


২. দুঃখের কারণ আর্যসত্যঃ 

প্রত্যেক ঘটনার এক বা একাধিক কার নিহিত থাকে পূর্ববর্তী ঘটনা পরবর্তী ঘটনার কারণ হিসাবে চিহ্নিত হয়। আবার পরবর্তী ঘটনার কারণে নতুন ঘটনার সৃষ্টি হয়। এই জগৎ দুঃখের কারণ আছে। তাহল তৃষ্ণা। জীব যা দেখে, শোনে বা আঘ্রান নেয় সেই মনোজ্ঞ ইন্দ্রিয় গোচর বিষয়কে লাভ করার জন্য তার প্রবল আকাঙ্খা জাগে। এর থেকে লোভ, মায়া, মোহ বন্ধনের সৃষ্টি। ভোগে এর তৃপ্তি হয় না, বরং তা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। ত্যাগেই সমাপ্তি।

বিষয়ানুসারে তৃষ্ণা ছয় প্রকার রূপতৃষ্ণা, শব্দতৃষ্ণা, গঙ্গতৃষ্ণা, রসতৃষ্ণা, স্পর্শতৃষ্ণা ধর্মতৃষ্ণা চক্ষু ইন্দ্রিয়ের সাথে রূপ আলম্বনের সমন্বয়ে বেদনা প্রসূত তৃষ্ণা হল রূপতৃষ্ণা কর্ণ ইন্দ্রিয়ের সাথে শব্দ আলম্বনের সংঘর্ষে উৎপন্ন বেদনা থেকে আগত তৃষ্ণা শব্দতৃষ্ণা এভাবে ছয় প্রকারের তৃষ্ণা এই ছয় প্রকারের তৃষ্ণা আবার একেকটি প্রবর্তনের আকারে কামতৃষ্ণা, ভবতৃষ্ণা, বিভবতৃষ্ণা হিসাবে বিভক্ত।

রূপ তণ্হাদি ভেদেন তণ্হা ইধ দীপিতা,

একেকা তিবিধা তাথ পবত্তাকারতো মতা।(alert-success)

(রূপতৃষ্ণাদি ভেদে এখানে ছয় প্রকার তৃষ্ণার উল্লেখ আছে। তথায় প্রবর্তনাকারে প্রত্যেকটি তিন প্রকারের বলে স্বীকৃত।)

রূপতৃষ্ণা যখন চক্ষুর গোচরে আগত রূপাবলম্বনকে কামের আস্বাদ অনুসারে আস্বাদন করতে করতে প্রবর্তিত হয়, তখন তা কাম- তৃষ্ণা। এই কামতৃষ্ণা যখন এই জগৎ শাশ্বত, ধ্রুব, নিত্য এরূপ শ্বাশ্বত দৃষ্টির সাথে প্রবর্তিত হয় এবং কামলোক, রূপলোক, অরূপলোকের জীবন-তৃষ্ণা জাগে, তখন ইহা ভব তৃষ্ণা 

এই কামতৃষ্ণা যখন বিনাশধর্মী, উচ্ছেদ স্বভাব বিশিষ্ট বলে উচ্ছেদ-দৃষ্টির সাথে প্রবর্তিত হয়, তখন ইহা বিভবতৃষ্ণা নামে কথিত। শব্দ, গন্ধ তৃষ্ণাদির মধ্যেও এই নিয়ম রূপ, শব্দ তৃষ্ণাদি কাম, ভব, বিভব তৃষ্ণা ভেদে (×) ১৮ প্রকার।

আবার অধ্যাত্ন ভেদে ১৮ প্রকার, বাহ্যিক ভেদে ১৮ প্রকার, মোট ৩৬ প্রকার তৃষ্ণা। বর্তমান কালের ৩৬ প্রকার, অতীত কালের ৩৬ প্রকার, ভবিষ্যৎ কালের ৩৬ প্রকার, সর্বমোট ১০৮ প্রকার তৃষ্ণা ইহারা পুনরায় সংক্ষিপ্ত হলে রূপাদি আলম্বন বশে ছয় প্রকার, কাম তৃষ্ণাদি ভেদে তিন প্রকারে পরিণত হয় এই সকল তৃষ্ণা হেতু জন্ম, এরপর জরা, ব্যাধি ইত্যাদি দুঃখ চক্র আকারে ঘুরে আসে


দুঃখ নিরোধ আর্যসত্যঃ 

কোন ঘটনার কারণ যখন জানা যায় তখন সেই ঘটনাকে নিরসন করা সহজ হয়। ডাক্তারগণ রোগীদের রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা করার জন্য প্রথমে কারণ অনুসন্ধান করেন। কারণ চিহ্নিত করতে পারলে রোগ আরোগ্য করতে পারেন। 

অনুরূপ দুঃখের কারণ ধরতে পারলে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ সহজেই করা যায়। কারণ রোধ হলে দুঃখের অবসান হয় দ্বিতীয় আর্যসত্যে দুঃখের কারণ যে সকল প্রকার তৃষ্ণা তা জানা গেল তৃষ্ণা নির্মূল হলে জন্ম নিরোধ হবে জন্ম নিরোধ হলে সকল দুঃখের সমাপ্তি ঘটবে জন্ম নিরোধ হল নির্বাণ।


দুঃখ নিরোধের উপায় আর্যসত্যঃ 

অষ্টাঙ্গ মার্গ হল দুঃখ নিরোধের উপায় মার্গ শব্দের অর্থ হল পথ আটটি পথ অনুসরণ করলে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করা যায় বুদ্ধ বলেছেন-

মগগান ট্ঠাঙ্গিকো সেট্ঠো সচ্চানং চতুরো পদা।

বিরাগো সেট্ঠো ধম্মানং দ্বিপদানঞ্চ চক্খুমা।

এসো মগ্গো নত্থঞঞো দস্সনস বিসুদ্ধিয়া।

এতং হি তম্হে পটিপজ্জথ মারস্সেতং পমোহনং।

এতং হি পটিপন্না দুখস্সন্তং করিস্সথ।(alert-success)

সকল মার্গের মধ্যে অষ্টাঙ্গিক মার্গ শ্রেষ্ঠ, সকল সত্যের মধ্যে চার আর্যসত্য শ্রেষ্ঠ, ধর্মের মধ্যে বৈরাগ্য শ্রেষ্ঠ, মানুষের মধ্যে চক্ষুষ্মান শ্রেষ্ঠ এই একমাত্র পথ সম্যক জ্ঞানের অন্য পথ নেই। তোমরা এই পথই অনুসরণ কর, এতেই দুঃখ ঘুচবে।

এই আটটি মার্গ হল-

  • . সম্যক দৃষ্টি
  • . সম্যক সংকল্প
  • . সম্যক বাক্য
  • . সম্যক কর্ম
  • . সম্যক আজীব
  • . সম্যক ব্যায়াম
  • . সম্যক স্মৃতি
  • . সম্যক সমাধি।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.