বৌদ্ধ দর্শনে জগৎ সৃষ্টি
দীর্ঘ নিকায়ের কেবউ সূত্রে আছে, ব্রহ্মকায়িক দেবগণ মহাব্রহ্মাকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হিসাবে উল্লেখ করেছেন এবং মহাব্রহ্মাত্ত নিজেকে সর্বশক্তিমান, সর্বদর্শী, কর্তা, নির্মাতা, শ্রেষ্ঠ নিয়ন্তা, ঈশ্বর হিসাবে মেনে নিয়েছেন।
জগৎ লয় হবার পর দীর্ঘসময় অতিক্রান্তে কিভাবে আবার পুনরাবর্তন হয় এবং সত্ত্বগণের উৎপত্তি কিভাবে হয় এর একটি ধারাবাহিক পর্যায় দীর্ঘ নিকায় গ্রন্থের ‘অগগঞঞ সূত্র’তে পাওয়া যায়। পর্যায়টি নিম্নরূপ-
ভগবান শ্রাবস্তীর পূর্বারাম নামক মিগার মাতার প্রাসাদে অবস্থান করছিলেন। তখন ব্রাহ্মণ পুত্র বাসেঠকে বুদ্ধ বললেন, বাসেট্ট, এমন সময় আসে যখন, আজই হোক, কিংবা কালই হোক, দীর্ঘকাল অতীত হবার পর জগৎ লয় প্রাপ্ত হয়। ঐরূপ সময়ে জীবগণ বহুল পরিমাণে আভাস্বর (ব্রহ্মলোক) জগতে পুর্নজন্ম লাভ করে সুদীর্ঘকাল অবস্থান করে। দীর্ঘ সময় অতীত হবার পর এই জগতের বিবর্তন হয়। বিবর্তন কালে সত্বগণ বহুল পরিমাণে আভাস্বর কায় হতে চ্যুত হয়ে এই জগতে আবির্ভূত হয়। তারা মনোময় হয়ে থাকে, প্রীতি তাদের ভক্ষ্য স্বরূপ হয়, তারা স্বয়ংপ্রভ, অন্তরীক্ষচর ও শুভস্থায়ী হয়ে সুদীর্ঘকাল অবস্থান করে।
তখন সমস্ত পৃথিবী জলময় ও অন্ধকার হয়। চন্দ্র-সূর্যের আর্বিভাব হয়
না, নক্ষত্র-তারকাদির প্রকাশ হয় না। দিবা-রাত্রি নেই, মাসার্ধ অথবা মাস নেই, ঋতু ও সংবৎসর নেই, স্ত্রীত্ত নেই পুরুষও নেই। সত্ত্বগণ সত্ত্বরূপেই গনিত হয়। বাসেট্ট, এরূপে দীর্ঘকাল অতীত হবার পর এমন সময় আসে তখন ঐ সকল সত্ত্বগণের নিকট জলোপরি রসসংযুক্ত পৃথিবী বিস্তৃত হল। যেরূপ উত্তপ্ত
দুদ্ধ শীতল হলে উহার উপর শর বিস্তৃত হয়, সেরূপ পৃথিবীর আবির্ভাব হল। উহা বর্ণ-গন্ধ-রসসম্পন্ন হল, উত্তমরূপে সম্পাদিত যেরূপ হয়, সেরূপ। বর্ণসম্পন্ন হল, বিশুদ্ধ ক্ষুদ্রা-মধুর ন্যায় আস্বাদসম্পন্ন হল।
তৎপরে, বাসেট্ট, ঐ সকল সত্ত্ব রসমৃত্তিকা উপভোগ করে মৃত্তিকাভোজী হয়ে উহাতে পুষ্ঠি লাভ করে সুদীর্ঘকাল অবস্থান করল। যে পরিমাণ তারা পুষ্ঠ হল সেই পরিমাণে তাদের দেহ কঠিনত্ব প্রাপ্ত হল এবং বর্ণেও বৈচিত্র্য প্রকাশিত হল। কোন সত্ত্ব সুরূপ, কোন সত্ত্ব কুরূপ হল। এস্থলে যারা সুরূপ হল তারা কুরূপদেরকে অবজ্ঞা করতে লাগল। ঐ সকল গর্বিত এবং অহমিকাসম্পন্ন প্রাণীগণের বর্ণাভিমান হেতু পৃথিবীর রস আস্বাদ অহিত হল। এতে প্রাণীগণ একত্রিত হয়ে বিলাপ করতে লাগল, “হায় রস, হায় রস।” ফলে রস পৃথিবী অন্তর্হিত হওয়ার পর ভূমি-পৰ্পটের আর্বিভাব হল। উহা বর্ণ, গন্ধ ও রস সম্পন্ন হল। সুসম্পাদিত ঘৃত বা নবনীতের ন্যায় বর্ণবিশিষ্ট হল, বিশুদ্ধ ক্ষুদ্রা-মধুর ন্যায় আস্বাদ বিশিষ্ট হল। তখন সকল সত্ত্ব ভূমি-পৰ্পট আহার করতে আরম্ভ করল। ফলে পুষ্টিতে দেহ অধিকতর কঠিনত্ব প্রাপ্ত হল এবং বর্ণেরও অধিকতররূপে বৈচিত্র্য প্রকাশিত হল। কোন সত্ত্ব সুরূপ এবং কোন সত্ত্ব কুরূপ হল। এস্থলে যারা সুরূপ তারা কুরূপদেরকে অবজ্ঞা করতে লাগল। ঐ সকল গর্বিত এবং অহমিকাসম্পন্ন প্রাণীগণের বর্ণাভিমান হেতু ভূমি-পৰ্পট অন্তহিত হল।
তৎপরে বদারলতার মধুর আস্বাদ সম্পন্ন লতা বিশেষ উৎপত্তি হল। তাও উপরে উল্লেখিত নিয়মে অহমিকা সম্পন্ন প্রানীদের বর্ণাভিমান হেতু বদালতা অন্তর্হিত হল। অত:পর সালির উদ্গত হল। উহা বর্ণহীন, তুষহীন সুগন্ধ তন্ডুল। ঐ সকল সত্ত্ব উক্ত সালি উপভোগ করে উহা ভোজনে নিরত হয়ে পুষ্টি লাভ করে সুদীর্ঘকাল অবস্থান করল। যে পরিমাণে তারা পুষ্টি হল সেই পরিমাণে তাদের দেহ অধিকতর কঠিনত্ব প্রাপ্ত হল এবং বর্ণেরও অধিকতর বৈচিত্র্য প্রকাশ পেল। স্ত্রী জাতীয় (পূর্ব জন্মে যারা স্ত্রী ছিল) জীবগণের স্ত্রী লিঙ্গ, পুরুষ জাতীয়গণের পুরুষ লিঙ্গ প্রার্দুভূত হল। স্ত্রীগণ অত্যাধিকরূপে পুরুষগণের প্রতি, পুরুষগণ স্ত্রীগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে লাগল। ফলে তাদের রাগের উৎপত্তি হল, দেহে প্রদাহ প্রবেশ করল। প্রদাহ হেতু তারা মৈথুন ধর্মের সেবা করল। বাসেট্ট মৈথুন নিরত সত্ত্বগণকে দেখে কেহ কেহ ধুলি, কেহ ভস্ম, কেহ বা গোময় নিক্ষেপ করতে লাগল, “দূর হও!
সত্ত্ব সত্ত্বের প্রতি কেন এরূপ আচরণ করবে? ঐ সমযে যে সকল সত্ত্ব মৈথুন ধর্মের সেবা করত তারা একমাস, দুই মাস পর্যন্ত গ্রামে, নগরে প্রবেশ করতে পারত না। যেহেতু বাসেট্ট, ঐ সকল সত্ত্ব ঐ সময়ে অসৰ্দ্ধমে অত্যধিকরূপে অধ:পতিত হয়েছিল, সেই হেতু তারা ঐ অধম গোপন করবার জন্য গৃহ নির্মাণ করতে আরম্ভ করল। অত:পর বাসে কোন এক অলস প্রকৃতির সত্ত্ব চিন্তা করল, ‘সায়াহ্নে সায়মাশের নিমিত্ত, প্রাতে প্রাতরাশের নিমিত্ত সালি একবারেই সংগ্রহ করব, সেই সত্ত্ব সায়মাশ এবং প্রাতরাশের নিমিত্ত একবারেই সালি সংগ্রহ করল। তখন অন্য সত্ত্বগণ তাকে অনুকরণ করে কেহ দুইদিনের, কেহ চার দিনের, কেহ আট দিনের জন্য সংগ্রহ করতে লাগল। বাসেট্ট, যখন হতে সত্ত্বগণ সঞ্চিত সালি আহার করতে লাগল তখন হতে তা কণবদ্ধ, তুষবদ্ধ হল, যে স্থান হতে উৎপাঠিত হয়েছিল সেই স্থানে পুনরায় উৎপন্ন হলনা এবং উৎপাটন স্থান দৃষ্ট হল, সালি-স্থান সমূহ গুল্মকারে অবস্থান করল।
তৎপরে বাসেঠ, সত্ত্বগণ একত্রিত হয়ে বিলাপ করতে লাগল যে, আমাদের মধ্যে পাপ ধর্মের প্রার্দুভাব হওয়ায় সকল সুবিধা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তখন ঐ সকল সত্ত্ব সালিক্ষেত্র বিভক্ত করে উহার সীমা নির্ধারণ করল।
অনন্তর বাসেট্ট, লোভ-প্রকৃতি সম্পন্ন কোন এক সত্ত্ব আপনার অংশ রক্ষা করতে করতে অদত্ত অপরের অংশ গ্রহণপূর্বক উহা উপভোগ করল। সত্ত্বগণ তাকে ধৃত করে পুনরায় এরূপ না করার জন্য নিষেধ করল। সে‘তথাস্তু’ বলে প্রতিশ্রুতি দান করে দ্বিতীয় বারও এরূপ করল, তৃতীয় বারও এরূপ করল। সত্ত্বগণ তার পাপ কর্মের জন্য হস্তদ্বারা, কেহ বা মৃৎপিন্ড দ্বারা, কেহ বা দন্ড দ্বারা প্রহার করল। ঐ সময় থেকে চৌর্যের প্রকাশ হল, নিন্দা, মুষাবাদ এবং দন্ড প্রয়োগের আবির্ভাব হল।
তৎপরে, বাসেট্ট, সত্ত্বগণ একত্রিত হয়ে বিলাপ করল, সত্ত্বগণের মধ্যে পাপধর্মেও প্রার্দুভাব হয়েছে, চৌয, নিন্দা, মুষাবাদ এবং দন্ড প্রয়োগের আর্বিভাব হয়েছে, অতএব আমরা এক সত্তাকে নির্বাচিত করব। ঐ সত্ত্ব ক্রোধের উপযুক্ত স্থানে ক্রোধ প্রকাশ করবেন, নিন্দার স্থানে নিন্দা প্রয়োগ করবেন, যে নির্বাসনের যোগ্য তার নির্বাসনের ব্যবস্থা করবেন। আমরা সালির অংশ তাকে প্রদান করব। তখন তাদের মধ্যে যে সত্ত্ব অপেক্ষাকৃত অভিরূপ, দর্শনীয়, প্রাসাদিক এবং মহাশক্তিশালী তাকে নির্বাচন করল। সে যথাস্থানে ক্রোধ, নিন্দা, নির্বাসন প্রয়োগ করল এবং সত্ত্বগণ তাকে সালির অংশ দিল।
বাসেট্ট, মহাজন নির্বাচিত এই অর্থে মহা-সম্মত, মহাসম্মত এই প্রথম নামের আর্বিভাব হল। ক্ষেত্রের পতি এই অর্থে ‘ক্ষত্রিয়’ রূপ দ্বিতীয় নামের আর্বিভাব হল। ধর্মের দ্বারা অপরের প্রতি উৎপাদন করেন এই অর্থে রাজা রূপ তৃতীয় নামের আর্বিভাব হল। সত্ত্বগণের কেহ কেহ চিন্তা করল,“সত্ত্বগণের মধ্যে পাপ ধর্মের প্রার্দুভাব হয়েছে, চৌর্য, নিন্দা ও মুষাবাদের আর্বিভাব হয়েছে, দন্ড প্রয়োগ ও নির্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। অতএব আমরা পাপ অকুশল ধর্ম বর্জন করব। তারা পাপ অকুশল ধর্ম বর্জন করল। বাসেট্ট, পাপ-অকুশল ধর্ম বর্জন করে এই অর্থে “ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ” এই নামের প্রথম আর্বিভাব হল। ঐ সকল সত্ত্বের মধ্যে কেহ কেহ মৈথুন ধর্মে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হল। “মৈথুন-ধর্মে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত” ইহা হতে বাসেট্ট, “বৈশ্য” এই নামের আর্বিভাব হল। তাদের উৎপত্তি ঐ সকল সত্ত্বগণ হতে, অন্য কোন সত্ত্ব হতে নহে।
তৎপরে বাসেট্ট, ঐ সকল সত্ত্বগণের মধ্যে যারা অবশিষ্ট থাকল তারা রুদ্ৰাচরণ সম্পন্ন হল।” রুদ্রাচার, ক্ষুদ্রাচার” ইহা হতে শূদ্র, শূদ্র' এই নামের উৎপত্তি হল এবং শূদ্রমন্ডলের উৎপত্তি হল। তা ঐ সকল সত্ত্বগণ হতে, অন্য কোন সত্ত্ব হতে নহে। এমন সময় আসল যখন ক্ষত্রিয়ও স্বধর্মের প্রতি বিরূপ হয়ে গৃহত্যাগপূর্বক গৃহহীন প্রব্রজ্যার আশ্রয় গ্রহণ করল। ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্ৰত্ত এরূপ করল। এ চতুবিধ মন্ডল হতে শ্ৰমণমন্ডলের উৎপত্তি হল। তা ধর্মানুসারেই, উৎপত্তি হয়েছে, অধর্মানুসারে নহে।
বাসেট্ট, ক্ষত্রিয়ও কায়, বাক্য, এবং মনের দ্বারা দুরাচারে রত হয়ে, মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে ঐরূপ দৃষ্টি অনুযায়ী কর্মফলে মরণান্তে দেহের বিনাশে অপায় দুর্গতি সম্পন্ন বিনিপাত নিরয়ে উৎপন্ন হয়।
বাসেট্ট, ক্ষত্রিয়ও কায়, বাক্য, এবং মনের দ্বারা সদাচারে রত হয়ে, সম্যক দৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে ঐরূপ দৃষ্টি অনুযায়ী কর্মের ফলে মরণান্তে দেহের বিনাশে সুগতি সম্পন্ন স্বর্গলােকে উৎপন্ন হয়। ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র, শ্রমণও ঐরূপ আচরণের ফলে ঐরূপ গতি প্রাপ্ত হয়।
বাসেট্ট, ক্ষত্রিয়ও কায়, বাক্য ও মনের দ্বারা পাপ ও পুণ্য উভয়বিধ কর্মের কারক হয়, মিশ-দৃষ্টি সম্পন্ন হয় এবং ঐরূপ দৃষ্টি অনুসরণ করে তদানুযায়ী কর্মের ফলে মরণান্তে দেহের বিনাশে সুখ-দু:খ বেদনা অনুভব করে। ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র, শ্ৰমণও ঐরূপ আচরণের ফলে ঐরূপ গতি প্রাপ্ত হয়।
বাসেট্ট, ক্ষত্রিয়ও কায় সংযত, বাক-সংযত, চিত্ত সংযত হয়ে সপ্ত বোধিপক্ষীয় ধর্ম ভাবনা করে ইহলোকেই পরিনির্বাণ লাভ করে। ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র, শ্রমণও ঐরূপ আচরণের ফলে ইহলোকেই পরিনির্বাণ লাভ করে। বাসে, এই চতুরবর্ণের মধ্যে যিনি ভিক্ষু, অহৎ, ক্ষীণাসব, ভারমুক্ত, ভববন্ধনমুক্ত, সম্যক জ্ঞাণ-বিমুক্ত হন, তিনি উহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আখ্যা লাভ করেন এবং তা ধর্মানুসারেই হয়ে থাকে, অধর্মানুসারে নয়। মানুষের মধ্যে ইহলোকে এবং পরলোকে ধর্মই শ্রেষ্ঠ।
অতএব জগতের লয়, সৃষ্টি, সত্ত্বগণের উৎপত্তি, বিভিন্ন নাম, গোত্র, সম্প্রদায়ের ক্রমবিস্তার এবং বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ যে কিভাবে হয় তা আমাদের কাছে স্পষ্ট । অতীতে যেমন এ ধারা ছিল, ভবিষ্যতেও এ রীতিতেই চলবে। ইহা জগতের শাশ্বত সংবিধান। এ সংবিধান কোন কালেই লংঘিত হবে না।
কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ।